ইসলামে নারীর কর্মসংস্থান : একটি পর্যালোচনা
মানুষকে মহান আল্লাহ সৃষ্টি করে তাদেরকে পুরুষ-নারী দু’টি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। এই দুই শ্রেণীর কর্মকান্ড ও কর্মপন্থায় বেশ ব্যবধান ও বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। এ বৈচিত্র্য বিশ্ব ব্যবস্থার অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। এই কর্মপন্থাগত ব্যবধান-বৈচিত্র্যের সীমানা প্রাচীরকে মিটিয়ে দেয়া হ’লে বিশ্বব্যবস্থায় নানা জটিলতা ও সমস্যা সৃষ্টি হবে। আল্লাহ তা‘আলা নারী-পুরুষকে যেভাবে স্বভাবগত এবং গঠনগত স্বাতন্ত্র্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন তেমনিভাবে জাগতিক ও ধর্মীয় জীবনে তাদের কর্মপন্থা ও দায়-দায়িত্বও ভিন্নতর করে দিয়েছেন। এটা সৃষ্টির প্রতি মহামহিম স্রষ্টার অতিশয় দয়ার বহিঃপ্রকাশ।
নারীর প্রধানতম কর্তব্য হ’ল, সংসার পরিচালনা করা, পরিবারের সার্বিক দিক লক্ষ্য রাখা এবং তার সন্তানদের প্রতিপালন-পরিচর্যা করা। শিক্ষা-দীক্ষাসহ সার্বিকভাবে যোগ্য করে গড়ে তোলা। সেই সাথে তার স্বামীর সেবা-যত্ন করা।[1] এমনকি নারীরা বাড়িতে স্বামীর খেদমতের সাথে গৃহস্থালীর কাজগুলো করলে সে জিহাদের সমপরিমাণ ছওয়াব পাবে।[2]
অন্যদিকে নারীর খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানসহ ব্যক্তিগত প্রয়োজন, সংসার পরিচালনা ও সন্তান-সন্ততি লালন-পালনসহ পারিবারিক ও সামাজিক সকল ব্যয়ভার থেকে নারী সম্পূর্ণরূপে মুক্ত। এসব যাবতীয় দায়ভার স্বামী বা পিতার উপর আরোপিত হয়েছে। ইসলামে নারীর যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করা পিতা অথবা স্বামীর উপর আবশ্যক করেছে।
সংসারের যাবতীয় দায়ভার পুরুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার কারণ হ’ল শক্তি-ক্ষমতা, জ্ঞান-বুদ্ধি সহ কতিপয় স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দিয়ে পুরুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। নেতৃত্বের প্রধান উৎস-উপাদান হ’ল সেবাব্রত। সেবার যাবতীয় দায়িত্ব দিয়ে পুরুষকে নারীর অভিভাবক করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন,الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَبِمَا أَنْفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ حَافِظَاتٌ لِلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ اللهُ، ‘পুরুষেরা নারীদের অভিভাবক। এজন্য যে, আল্লাহ একের উপর অন্যকে প্রাধান্য দান করেছেন এবং এজন্য যে, তারা (নারীদের ভরণ-পোষণের জন্য) তাদের মাল-সম্পদ হ’তে ব্যয় করে থাকে। অতএব সতী-সাধ্বী স্ত্রীরা হয় অনুগত এবং আল্লাহ যার হেফাযত করেছেন, আড়ালেও (সেই গুপ্তাঙ্গের) হেফাযত করে’ (নিসা ৪/৩৪)। অন্যত্র তিনি বলেন,وَعَلَى الْمَوْلُودِ لَهُ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ لَا تُكَلَّفُ نَفْسٌ إِلَّا وُسْعَهَا، ‘আর জন্মদাতা পিতার দায়িত্ব হ’ল ন্যায়সঙ্গতভাবে প্রসূতি মায়েদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা। সাধ্যের অতিরিক্ত কাউকে বাধ্য করা যাবে না’ (বাক্বারাহ ২/২৩৩)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে স্ত্রীর প্রতি পুরুষের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হ’লে তিনি বলেন,أَنْ تُطْعِمَهَا إِذَا طَعِمْتَ، وَتَكْسُوَهَا إِذَا اكْتَسَيْتَ، أَوِ اكْتَسَبْتَ، ‘যখন তুমি আহার করবে তখন তাকেও (স্ত্রী) আহার করাবে, যখন তুমি বস্ত্র পরিধান করবে তখন তাকেও বস্ত্র পরিধান করাবে’।[3] অন্যত্র তিনি বলেন, وَحَقُّهُنَّ عَلَيْكُمْ أَنْ تُحْسِنُوْا إِلَيْهِنَّ فِىْ كِسْوَتِهِنَّ وَطَعَامِهِنَّ- ‘আর তোমাদের উপর তাদের অধিকার এই যে, তোমরা (যথাসম্ভব) তাদের পোষাক-পরিচ্ছদ ও আহারের সুব্যবস্থা করবে’।[4]
স্বামীর এ অভিভাবকত্বব অতিরিক্ত ক্ষমতা কিংবা দাপটের বিষয় নয়; বরং এটা তার দায়িত্ব ও কর্তব্য। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে প্রিয় জীবনসঙ্গিনীকে আগলে রাখার নিখাদ প্রচেষ্টা। আর শীতল ছায়ায় থেকে ঘর গোছানো ও সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যত গড়ার তুলনামূলক সহজসাধ্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছে নারীকে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَى أَهْلِ بَيْتِ زَوْجِهَا وَوَلَدِهِ وَهِىَ مَسْئُولَةٌ عَنْهُمْ، ‘নারী তার স্বামীর পরিবার ও সন্তান-সন্ততির উপর দায়িত্বশীল। সে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে’।[5]
নারীর কর্মসংস্থান :
কর্মসংস্থান বলতে এমন কর্মব্যবস্থাপনা বুঝায় যাতে অংশ গ্রহণ করে একজন মানুষ তার আর্থিক প্রবৃদ্ধি ঘটাতে সক্ষম হয়। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনের একান্ত প্রয়োজনীয় খাতের ব্যয় নির্বাহ করার জন্যই মানুষ কর্মসংস্থানের মুখাপেক্ষী হয়। কিন্তু ইসলামী আইনে বিশেষ প্রয়োজন ব্যতিরেকে নারীর উপর ব্যয় নির্বাহের কোন দায় চাপিয়ে দেয়া হয়নি। নারীর যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করবে পুরুষ। সুতরাং নারীর কর্মসংস্থানের কোন প্রয়োজন নেই এবং থাকার কথাও নয়। স্বভাবজাত ও প্রাকৃতিকভাবেই নারীরা সংসারী। ঘরোয়া কাজের সাথে তাদের সংশ্লিষ্টতা ও আগ্রহবোধ একান্তই সৃষ্টিগত। সে হিসাবে তারা নিজ আগ্রহেই সংসার পরিচালনা করে থাকে। এক্ষেত্রে যদি তাদেরকে সাংসারিক এবং প্রাসঙ্গিক ব্যয় নির্বাহের উদ্দেশ্যে কর্মসংস্থানে যেতে বাধ্য করা হয় তবে এটা হবে তাদের উপর নিতান্তই বৈষম্যমূলক আচরণ। তাই শরী‘আতে নারীদেরকে কর্মসংস্থানমুখী করতে বাধ্য করার কোন সুযোগ নেই।
তবে নারী সমাজের কর্মতৎপরতা কেবলমাত্র বিদ্যা শিক্ষা, জ্ঞান অর্জন ও চিন্তা-গবেষণার ক্ষেত্র পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে ইসলাম এমন কথা বলেনি; বরং বাস্তব কাজে যথার্থ ভূমিকা পালনের জন্যে ইসলাম এক বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র তাদের জন্যে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে নারী যেমন জ্ঞান-বিজ্ঞানে শিক্ষা লাভে অগ্রসর হ’তে পারে, তেমনি কৃষি ও ব্যবসায়ের কাজে পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে।
জীবিকার জন্যে বিভিন্ন কাজ কারবার, শিল্প-কারখানা স্থাপন, পরিচালনা বা তাতে কাজ করারও অধিকার রয়েছে নারীদের। সেই সঙ্গে সমাজ ও জাতির কল্যাণমূলক বহুবিধ সামষ্টিক কাজ আঞ্জাম দেয়াও তাদের জন্যে বৈধ। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, নারীদের এসব কাজে নেমে যেতে হবে এবং এসব করা তাদের জন্য একান্ত যরূরী হয়ে পড়েছে। নারীরা এসব কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ুক ইসলামে তা কাম্য নয়। তবে পরিবার বা সমাজে এমন কিছু পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যার কারণে নারীদেরও কর্মসংস্থানের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তখন যথাসাধ্য শারঈ বিধান পালন সাপেক্ষে নারীদের জন্যও কর্মসংস্থানের অনুমতি ইসলাম দিয়েছে। তবে তাদের আলাদা কর্মক্ষেত্রের ব্যবস্থা করতে হবে। নারী-পুরুষের স্বাধীন ও অবাধ মেলামেশার ফলে সামাজিক জীবনে নৈতিক অধঃপতনের যে মারাত্মক ব্যধি দেখা দিয়েছে তা থেকে সমাজকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যেই ইসলামে পর্দার বিধান আরোপ করা হয়েছে। আজকের নারীরা পর্দাকে অবরোধ ভাবছে। অথচ ইসলাম নারীকে শৃঙ্খলিত করেনি। পর্দার মাধ্যমে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। তাকে সংযত হ’তে এবং নিজেকে খোলা-খুলিভাবে প্রকাশ না করতে ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে।
ইসলাম নারীদেরকে কর্মসংস্থান গ্রহণের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। তার জন্য ক্রয়-বিক্রয় বা ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিনিধি নিয়োগসহ যাবতীয় লেনদেনে অংশগ্রহণ করতে পারে। তবে তাকে এ জাতীয় কারবারে অংশগ্রহণ করে শারঈ বিধান ও আচরণ বিধির ব্যাপারে যত্নবান হ’তে হবে।[6] নারীরা ৩টি শর্তে নিজ গৃহের বাইরে চাকুরি বা কাজ করতে যেতে পারবে,(১) ألا يكون العمل معصية (2) ألا يكون عملها مما يكون فيه خلوة بأجنبي (3) ألا تخرج لعملها متبرجة متزينة بما يثير الفتنة অর্থ : (১) কাজটি গোনাহের না হওয়া (২) নারীর কাজটি এমন না হওয়া যাতে পরপুরুষের সাথে নির্জনে কাজ করতে হয় (৩) কাজের জন্য এমন সাজসজ্জা সহকারে বেপর্দায় বের না হওয়া, যা ফিতনা-ফ্যাসাদের দিকে প্ররোচিত করে।[7]
নারীদের বাড়ীর বাইরের কাজ দু’ভাবে বিভক্ত। যথা-
১. এমন কাজ যেখানে নারীদের প্রয়োজন : ধাত্রী বা সন্তান জন্মদানে সহযোগিতা, মহিলাদের চিকিৎসা, বালিকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের শিক্ষাদান প্রভৃতি ক্ষেত্রে কেবল মহিলাদের প্রয়োজন।
২. এমন কাজ যা পুরুষরা পালন করে, নারীদের যা করার প্রয়োজন হয় না : কৃষিকাজ, খামার পরিচালনা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প কারখানা পরিচালনা বা কারখানায় কাজ করা প্রভৃতি। কেবল বাধ্যগত প্রয়োজন ও সক্ষমতা থাকলে পূর্বোক্ত শর্তসাপেক্ষে মহিলাদের জন্য এসব কাজ করা জায়েয।
Comments
Post a Comment