শূন্য থেকে হাজার কোটিতে আ’লীগ নেত্রী হেনরী

 



স্ত্রীর বদৌলতে স্বামী শামীম তালুকদার লাবুও গড়েছেন অঢেল সম্পদ। গত ১৫ বছরে প্রভাব খাটিয়ে স্বামী-স্ত্রী মিলে অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় বানানোর খবরটি যেন রূপকথার গল্পকেও হার মানায়।


ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষিকা। বেতন পেতেন মাত্র ১০ হাজার টাকা। শ্বশুরবাড়ির লোকজন আওয়ামী পরিবার হওয়ায় ভাগ্যগুণে হয়েছেন এমপিও। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীর কাছে হারলেও ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের আশীর্বাদে ২০০৯ সালে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য নিযুক্ত হওয়ার পর থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে ছক্কা মেরে অন্তত শূন্য থেকে দুই হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। গড়ে তুলেছেন আলিশান ফ্লাট বাড়ি, নিজ নামে রয়েছে স্কুল-কলেজ, রিসোর্ট, আরো রয়েছে এক ডজনেরও বেশি বিলাসবহুল গাড়ি এবং ঢাকা ও সিরাজগঞ্জে ক্রয় করেছেন বিঘার পর বিঘা জমি। বলছি সিরাজগঞ্জ-২ আসনের সাবেক এমপি জান্নাত আরা হেনরীর কথা। স্ত্রীর বদৌলতে স্বামী শামীম তালুকদার লাবুও গড়েছেন অঢেল সম্পদ। গত ১৫ বছরে প্রভাব খাটিয়ে স্বামী-স্ত্রী মিলে অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় বানানোর খবরটি যেন রূপকথার গল্পকেও হার মানায়।


স্কুলশিক্ষিকা থেকে আ’লীগের কেন্দ্রীয় নেত্রী : সিরাজগঞ্জ সদরের সদানন্দপুরের স্কুলশিক্ষক আবদুল হামিদ মিঞার মেয়ে জান্নাত আরা হেনরী। ১৯৮৮ সালে দশম শ্রেণিতে পড়াকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মোতাহার হোসেন তালুকদারের ছেলে শামীম তালুকদার লাবুর সাথে তার বিয়ে হয়। পরে সিরাজগঞ্জ জেলা শহরের সবুজ কানন স্কুল অ্যান্ড কলেজে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন হেনরী। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবেও তার পরিচিতি রয়েছে। রাজনৈতিক পরিবারের পুত্রবধূ হওয়ার সুবাধে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন তিনি। একপর্যায়ে কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পান। পাশাপাশি জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদও বাগিয়ে নেন তিনি।


সম্পদ বেড়েছে ৮৮৪ গুণ : ২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশনে দেয়া হলফনামার তথ্যানুযায়ী, জান্নাত আরা হেনরীর সম্পদের পরিমাণ ছিল স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি মিলে ছিল ছয় লাখ ৩৪ হাজার ৫০০ টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক আয় দেখান এক লাখ ২২ হাজার এবং ব্যয় উল্লেখ করেন ৮০ হাজার টাকা। ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেই হেনরীই হলফনামায় সম্পদ দেখান, ৫৬ কোটি ৮ লাখ ৯৫ হাজার ৬০২ টাকা। সম্পদ বৃদ্ধির হার হিসেবে যা ৮৮৪ গুণ। গত ১৫ বছরে স্ত্রীর পাশাপাশি স্বামী লাবুর সম্পদও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে সেটা ১৩৬ গুণ হয়েছে। হলফ নামায় ২০০৮ সালে সাত লাখ টাকা দেখালে ২০২৪ সালে গিয়ে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় সাড়ে ৯ কোটি টাকায়। হলফনামায় হেনরী শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখিয়েছিলেন এমএসএস প্রথম পর্ব। পেশা হিসাবে শিক্ষকতা, চিকিৎসা ও আইনি পরামর্শক দেখিয়েছিলেন তিনি। বিশ্লেষকরা বলছেন, হেনরীর এই সম্পদ গড়ার কাহিনী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাবশালীদের কিভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের সুযোগ দেয়া হয়েছিল তার একটি জীবন্ত উদাহরণ হয়ে থাকবে।


শূন্য থেকে যেভাবে কোটিপতি : হেনরীর কপাল খুলে যায় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়। সিরাজগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম দুর্নীতির মামলার কারণে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারায় তখন নৌকার টিকিট পান হেনরী। নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীর কাছে পরাজিত হলেও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের আশীর্বাদে হেনরী সোনালী ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হন। এরপর আর তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তার রোজগারের মেশিন যেন কয়েক শ’ গুণ গতি পায়। হলমার্ক কেলেঙ্কারির সুবিধাভোগী, ঋণ প্রদান, পদোন্নতির তদবিরসহ তৎকালীন আওয়ামী সরকারের মন্ত্রীদের সাথে তদবির বাণিজ্যের মাধ্যমে দু’হাত ভরে অর্থ কামিয়ে রীতিমতো রাতারাতি টাকার কুমিরে পরিণত হন তিনি। ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর সিরাজগঞ্জের একচ্ছত্র ক্ষমতাধর নেত্রী বনে যান তিনি । নিজে এমপি হওয়ার তিন মাসের মধ্যে ‘কয়েক কোটি টাকা’ খরচ করে স্বামী শামীম তালুকদারকে বানান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান। ঠিকাদারি ও নির্মাণসামগ্রী সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘মেসার্স লামিয়া এন্টারপ্রাইজ’সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে তুলেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কাঁড়ি কাঁড়ি সম্পদ। এলাকাবাসীর মতে, সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হওয়ার পর রাতারাতি শিল্পপতির কাতারে নাম উঠান হেনরী। যে হেনরী আগে রিকশায় চড়তেন, একলাফে উঠে যান কোটি টাকার ল্যান্ড ক্রুজারে। নিজের নামে ছাড়াও স্বামী লাবু এবং পালিত মেয়ের নামেও গড়েছেন অঢেল সম্পদ।


হেনরীর নামে-বেনামে যত সম্পত্তি : হেনরির সম্পদের মধ্যে রয়েছে সিরাজগঞ্জ সদরে সাততলা ভবন ও একটি ফ্ল্যাট। ঢাকার মিরপুরে রজনীগন্ধা কমপ্লেক্সে দু’টি ফ্ল্যাট। সিরাজগঞ্জের বাহুকা রতনকান্দি এলাকায় চার হাজার বর্গফুটের দু’তলা ভবন, ভূতেরদিয়া এলাকায় ০.০৬৩৭ শতাংশ জমির ওপর ভবন, ০.০৭০০ একর জমি এবং নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কামতা মৌজার ১৭ নং সেক্টরের ৪০২ নং সড়কের ৮ নং প্লটের ৫ কাঠা জমি। একই সেক্টরের ৩০৫ নং সড়কের ৪ নং প্লটের ৪ কাঠা জমি। পটুয়াখালীর খেপুপাড়ায় ২.৫১ একর জমি। সিরাজগঞ্জ সদরের বাহুকা-রতনকান্দি এলাকায় ১১টি পৃথক দলিলে (দলিল নং-৬৬৮৮, ৬৬৩৯, ৮২২, ৩৮৫৯, ৩৯৬৯, ৪৫৭৭, ৬১৮৫, ০৮০৮, ৩৮১০ ও ৩৯৫৬) সাড়ে ৩ একর, পূর্ব মোহনপুরে ০.৬১ একর, শিলন্দা ও বনবাড়ীয়ায় ৪.৬ একর, সদানন্দপুরে পাঁচটি পৃথক দলিলে ৪৫.১৫ শতাংশ জমি ক্রয় করেছেন যা আয়কর নথিতে উল্লেখ রয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া সিরাজগঞ্জের ভারাঙ্গা এলাকায় ১২টি পৃথক দলিলে (দলিল নং-৯৬৯, ৯৬৭, ৯৬৮, ৯৭১, ১২৪৬, ১০১৮, ৩৯৫৬, ১১১৬, ১০১৫, ৯৭২ ও ১৮০৭) ৫ একর এবং রায়গঞ্জে ২.১৮ একর জমি ক্রয় করেন তিনি। এটি তো গেল কেবল সরকারি হিসাব অনুযায়ী হেনরীর নামে ক্রয়কৃত সম্পদ। সরকারি হিসেবের বাইরেও গত ১৫ বছরে দুর্নীতি, অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে হেনরীর বেনামে হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পদ রয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।


নিজ নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাংলো বাড়ি ও রিসোর্ট করে আলোচনায় : সিরাজগঞ্জ ও গাজীপুরে হেনরীর নামে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেয়া বিপুল স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে- যা নিয়ে সর্বত্র আলোচনা ও সমালোচনা রয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, সিরাজগঞ্জ সদরের নলিছাপাড়ায় হেনরী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কলেজ, পাশেই হেনরী ইনস্টিটিউট অব বায়োসায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, শহরের ফজল খান রোডে হেনরী স্কলাসটিকা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, গড়ে তুলেছেন। গজারিয়ায় ‘হেনরী ভুবন’ নামে বিশাল বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করে রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন তিনি।

Countdown Timer
00:01

Comments

Popular posts from this blog

সালাউদ্দীন আহমেদ আর নেই

দেশে আবারও করোনায় মৃত্যু, শনাক্ত ৩

১২শ বস্তা চাল উদ্ধার প্রসঙ্গে উপদেষ্টা আসিফের বক্তব্য