মা অসুস্থ, তবুও যে কারণে ফিরতে পারছেন না তারেক রহমান
বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা অবনতির মধ্যেও লন্ডন থেকে দেশে ফিরতে পারছেন না তাঁর বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। পরিবার ও দলীয় শীর্ষ সূত্র বলছে, ব্যক্তিগত ইচ্ছা ও মানসিক চাপে থেকেও সম্ভাব্য নিরাপত্তা ঝুঁকি, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সমীকরণ তাঁর দেশে ফেরার পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালের সিসিইউতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। নিউমোনিয়া ও জটিল মাল্টি-অর্গান সমস্যার কারণে চিকিৎসা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। লন্ডন থেকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন তারেক রহমান ও তাঁর সহধর্মিণী ডা. জুবাইদা রহমান। কিন্তু পরিবারের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকলেও তারেক রহমানের দেশের মাটিতে মায়ের কাছে পৌঁছানো এখনো সম্ভব হয়নি।
দলীয় শীর্ষ সূত্র জানিয়েছে, তারেক রহমানের দেশে ফেরা ঠেকাতে একটি পার্শ্ববর্তী দেশের তৎপরতা এখনো সক্রিয় রয়েছে। এমনকি দেশের ভেতরে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ও আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কও তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে জাতীয় নেতাদের হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ ইতিহাস-গান্ধী, ইন্দিরা, রাজীব, বেনজির ভুট্টো থেকে শুরু করে জিয়াউর রহমান পর্যন্ত- তাঁর নিরাপত্তা-ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা।
বিএনপির এক স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেন, ‘তারেক রহমানের নিরাপত্তার বিষয়টি শুধু দেশ নয়, আন্তর্জাতিক ফ্যাক্টরেও জড়িয়ে আছে। এক মুহূর্তের ভুল সিদ্ধান্ত বড় বিপর্যয়ে নিয়ে যেতে পারে।’
এই কারণেই বুলেটপ্রুফ গাড়ি কেনা, অস্ত্র লাইসেন্সের আবেদন এবং গুলশানের বাসায় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রস্তুতি চলছে। তবে এখনো পুরোপুরি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি।
এছাড়াও তারেক রহমান বর্তমানে যুক্তরাজ্যে ইনডেফিনিট লিভ টু রিমেইন (আইএলআর) স্ট্যাটাসে রয়েছেন। দেশে ফিরতে হলে ট্রাভেল পাসসহ একাধিক প্রশাসনিক ধাপ অতিক্রম করতে হবে। পাশাপাশি তাঁর বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো দেশের আদালত কীভাবে বিবেচনা করবে-এ নিয়েও অনিশ্চয়তা আছে।
অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও লেখক ড. পিনাকী ভট্টাচার্য দাবি করেন, অতীতে বহিষ্কার এড়াতে তারেক রহমান ব্রিটিশ নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়, যার আইনি প্রক্রিয়াজনিত জটিলতাও তাঁর তাৎক্ষণিক ফেরায় প্রভাব ফেলতে পারে।
বিএনপির অভ্যন্তরেও শৃঙ্খলা ও নেতৃত্বের প্রশ্নে জটিলতা রয়েছে। পিনাকীর বিশ্লেষণে বলা হয়, দেশে ফিরলে দলে সৃষ্ট নানান দ্বন্দ্ব-বিশেষ করে টানাপোড়েন, চাঁদাবাজি বা মনোনয়ন-সংঘাত-তাঁর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনপূর্ব মুহূর্তে তাঁর আবির্ভাব দলের ভেতরের বিশৃঙ্খলা আড়াল করলেও ব্যবস্থাপনাগত ঝুঁকি তৈরি করবে বলে মনে করা হচ্ছে।সম্প্রতি তারেক রহমানের বক্তব্য ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন বিতর্কও তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য গণভোট এখন মূল বিষয় নয়; কৃষকের ক্ষতি পোষানো বা আলুর দাম নিয়ন্ত্রণই জরুরি।”
ড. পিনাকী ভট্টাচার্য এই মন্তব্যকে রাজনৈতিক দর্শনের সংকট হিসেবে দেখছেন। তাঁর মতে, ৫ আগস্টের বিপ্লব ছিল মর্যাদা, স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের জন্য-বাজারমূল্যের কারণে নয়। তিনি সতর্ক করে বলেন, জনগণকে কেবল ভোক্তা হিসেবে দেখলে তা হবে “অরাজনৈতিককরণ”।
এই তাত্ত্বিক বিতর্কও তারেক রহমানের দেশে ফেরার রাজনৈতিক সময়-নির্ধারণকে প্রভাবিত করছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকেরা।
সব জটিলতার মাঝেও সবচেয়ে মানবিক সংকটটি হলো মায়ের গুরুতর অসুস্থতা। পরিবার সূত্র বলছে, তারেক রহমান প্রতিদিনই কাঁদছেন, চিকিৎসকদের সঙ্গে রাতভর কথা বলছেন। তিনি ফিরতে চান-কিন্তু নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক বাধার কারণে বাস্তবতা তাঁকে ছাপিয়ে যাচ্ছে।
পরিবারের এক সদস্য সূত্র বলছেন, ‘উনি ফিরতে চান। কিন্তু পথটাই বন্ধ হয়ে আছে। নিরাপত্তা না পেলে আমরা তাকে দেশে আনতে পারি না।’
দলীয় সূত্র দাবি করছে, সব বাধা অতিক্রম করে আগামী মাসে তাঁর দেশে ফেরার প্রস্তুতি চলছে। বুলেটপ্রুফ গাড়ির অনুমোদন, বাসার সংস্কার, নিরাপত্তা ব্যবস্থার নকশা-সবকিছু দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। তবে পিনাকীর মতানুযায়ী-আন্তর্জাতিক ফ্যাক্টর, নিরাপত্তা ও আইনি জটিলতার সমাধান না হলে তাঁর ফেরা আরও বিলম্বিত হতে পারে।
মা শারীরিক সংকটের মধ্যেই তারেক রহমানের দেশে ফেরার অপেক্ষায় নেতাকর্মীরা। যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি ফিরতে পারবেন কি না-সময়ের অপেক্ষা ছাড়া এর উত্তর এখন আর কারও জানা নেই।

Comments
Post a Comment