ঢাকার কাছে এগিয়ে আসছে আরও ‘বড়’ ভূমিকম্প




বড় ভূমিকম্পে রাজধানী ঢাকার কী পরিণতি হতে পারে, তারই যেন আভাস দিয়ে গেল সাপ্তাহিক ছুটির দিনের সকালে মাঝারি মাত্রার ভূকম্পন। একশ বছরের মধ্যে দেশে বড় ভূমিকম্প না হলেও কম্পনের ইতিহাস রয়েছে। সেদিক থেকে গতকালের ভূমিকম্পটিকে ‘ফোরশক’ বলা যায়। একটি বড় ভূমিকম্পের সময় ঘনিয়ে আসার আগে যে ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়, গতকালেরটি তার মধ্যে একটি। পুরো দেশকে নাড়িয়ে দেওয়া ৫ দশমিক ৭ মাত্রার এই ভূমিকম্পকে ভবিষ্যতের বড় ভূমিকম্পের সতর্কবার্তা হিসেবে দেখে এখনই প্রস্তুতি নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন ভূতত্ত্ব ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা।



তারা বলছেন, ঢাকার এত কাছে এত বেশি মাত্রার ভূমিকম্প এর আগে কখনো ঘটেনি। কম্পনের স্থায়িত্ব আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড বেশি হলে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা ছিল। ভূমিকম্পে প্রাণক্ষয় কমাতে মহড়া বাড়ানোর পাশাপাশি সচেতনতা তৈরিতে জোর দিতে হবে।রাজধানীজুড়ে প্রায় ২১ লাখ ৪৬ হাজার ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে নগর সংস্থাগুলো। এসব ভবনের বেশিরভাগই নির্মাণ হয়েছে নিয়ম-কানুন না মেনে, পুরোনো নকশায় বা দুর্বল ভিত্তির ওপর। বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে সতর্ক করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুক্রবারের ভূমিকম্প ঢাকা থেকে খুব কাছে ও কয়েক দশকের মধ্যে মাত্রা বেশি হওয়ায় অধিকাংশ মানুষ কম্পন অনুভব করেছেন এবং আতঙ্ক বিরাজ করছে।



পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানিয়েছেন, ভূমিকম্পের দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে ঢাকা এবং পুরান ঢাকা। তিনি বলেন, ‘এখনকার বিল্ডিংগুলো কোড মেনে চললেও রাজউকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রচুর বিল্ডিং হয়ে গেছে যেগুলোর ৯০ শতাংশেরই কোনো অনুমোদন নেই। এগুলোর কী হবে, যদি এরকম ভূমিকম্প রিপিট (পুনরাবৃত্তি) করতে থাকে?’দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি ও জাইকার এক যৌথ জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, ঢাকায় সাত বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হলে শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে। এ ছাড়া ১ লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তৈরি হবে সাত কোটি টন কনক্রিটের স্তূপ।



বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের অবস্থান ইন্ডিয়ান প্লেটে এবং এই প্লেট উত্তরপূর্ব দিকে এগোচ্ছে। সিলেটের উত্তরে আছে ইউরেশিয়ান প্লেট, যেটি দক্ষিণমুখী। এই দুই প্লেট একটি অন্যটিকে চাপ দিচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের পূর্ব দিকে মিয়ানমার সাবপ্লেটেও সাবডাক্ট হয়েছে, উত্তরে ডাউকি ফল্ট আছে এবং পূর্বে মিয়ানমারের সাগাইং ফল্ট, মধুপুর ফল্ট থাকায় ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে।



আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘এবারের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ঢাকার একেবারে কাছেই ছিল, ফলে অনুভূত হয়েছে অনেক বেশি। চট্টগ্রামের রাঙামাটি বা খাগড়াছড়িতে যদি ৭ মাত্রার ওপরেও ভূমিকম্প হয়, তাহলে আমরা ঢাকায় এতটা ঝাঁকুনি অনুভব করি না। তবে এই ভূমিকম্পের স্থায়িত্বকাল আর ৫-৭ সেকেন্ড বেশি হলেই ঢাকার অনেক ভবনই ধসে পড়ত। এ ধরনের ভূমিকম্পের সম্মুখীন ঢাকা ও আশপাশের এলাকা আগে কখনো হয়নি।’



তিনি বলেন, ‘সাধারণভাবে মনে হতে পারে ৫ মাত্রার ভূমিকম্প থেকে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প মাত্র এক পয়েন্ট বেশি; কিন্তু বিষয়টি এমন না। ৫ মাত্রার চেয়ে ৬ মাত্রার ভূমিকম্পের কম্পনের প্রবণতা ১০ গুণ বেশি। এখানে প্রতিটি ভগ্নাংশ মানে এর তীব্রতা তত গুণ বেশি। ফলে এই ভূমিকম্পের প্রবণতা বা তীব্রতা অন্তত ১০০ কিলোমিটার রেডিয়াসে থাকে।’



ঢাকা ও এর আশপাশে ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল থাকার ঘটনা অতীতেও ঘটেছে, তবে মাত্রা ছিল কম। এর মধ্যে ২০১২ সালের ১৮ মার্চ ৪ দশমিক ৫ মাত্রা, ২০০৮ সালের ২৬ জুলাই ৪ দশমিক ৮ মাত্রা এবং ২০০১ সালের ১৯ ডিসেম্বর ৪ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ওই ঘটনাগুলোতে বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে ২০১১ সালের ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রামে ৬ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল।



ঐতিহাসিকভাবেও এ অঞ্চল বড় ভূমিকম্পের সাক্ষী। ১৮৯৭ সালের ‘গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক’ (৮ দশমিক ০ মাত্রা) তৎকালীন অবিভক্ত বাংলায় ১ হাজার ৫০০-এর বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। এ ছাড়া ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্প (৭ দশমিক ৬ মাত্রা) ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়েছিল।



রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ২০২৪ সালের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্টে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকার ৪০ দশমিক ২৮ শতাংশ থেকে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ ভবন ধসে পড়তে পারে। সমীক্ষা অনুযায়ী, দিনের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভূমিকম্প হলে হতাহতের সংখ্যাও ভিন্ন হতে পারে: সকালে হলে মৃত্যু হতে পারে ২ দশমিক ১ লাখ থেকে ৩ দশমিক ১ লাখ মানুষের; বিকেলে হলে এই সংখ্যা ২ দশমিক ৭ লাখ থেকে ৪ লাখ হতে পারে এবং রাতে হলে নিহতের সংখ্যা ৩ দশমিক ২ লাখ থেকে ৫ লাখে পৌঁছাতে পারে। এ ছাড়া সিলেটের লিনিয়ামেন্টে (ডাউকি ফল্ট লাইন) ৭ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকার ৪০ হাজার ৯৩৫টি থেকে ৩ লাখ ১৪ হাজার ভবন (১ দশমিক ৯১ শতাংশ থেকে ১৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ) ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।



মধুপুর ফল্টে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে অবকাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণও হবে ভয়াবহ। এতে প্রধান সড়কগুলোর ৪৯ দশমিক ৬ শতাংশ এবং শহরের ভেতরের সড়কগুলোর ৫৯ দশমিক ৪ শতাংশ ধসে যেতে পারে। সবচেয়ে আশঙ্কাজনক হলো, প্রধান সেতুগুলোর ৯৬ দশমিক ২২ শতাংশ এবং শহরের সেতুগুলোর ৯৬ দশমিক ৭৯ শতাংশ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। আর্থিক ক্ষতির হিসাবে, পরিবহন খাতে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি, পানি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সিস্টেমে ৮৮৭ মিলিয়ন ডলার এবং বিদ্যুৎ অবকাঠামোতে ২৭ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলার ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।



রাজউকের আওতাধীন এলাকায় বর্তমানে ২১ দশমিক ৫ লাখের বেশি ভবন রয়েছে, যার মধ্যে ৫ দশমিক ১৪ লাখ কনক্রিটের স্থাপনা। সমীক্ষায় ৩ হাজার ২৫২টি ভবন পরীক্ষা করে ৪২টিকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে অবিলম্বে ভেঙে ফেলার সুপারিশ করা হয়েছে।



সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির সমীক্ষা অনুযায়ী, ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্পে ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়বে এবং আরও দেড় লাখ ভবন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষ করে দুর্বল মাটির ওপর গড়ে ওঠা বহু পুরোনো ভবন এবং বিল্ডিং কোড না মেনে তৈরি করা ছয়তলার বেশি উঁচু ভবনগুলোই হবে প্রধান শিকার।



বিশেষজ্ঞরা ঢাকার ঝুঁকি বাড়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন। বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এই শহরে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা বহুতল ভবন, বস্তি এবং সরু রাস্তাগুলো বড় বাধা। অনেক ভবনই ভূমিকম্প সুরক্ষা মানদণ্ড মেনে তৈরি হয়নি, যা এগুলোকে মৃত্যুফাঁদে পরিণত করেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের মাটির গঠনগত দুর্বলতাও একটি বড় কারণ। দেশের বড় অংশই আলগা ও জলাবদ্ধ পলিমাটির ওপর গঠিত। শক্তিশালী কম্পনে এই মাটি তরলীকৃত হয়ে যেতে পারে, যা ভবন ধসের কারণ হতে পারে।

Countdown Timer
00:01

Comments

Popular posts from this blog

অজুর পর মূত্র ফোঁটা বেরিয়েছে মনে হলে যা করবেন, জেনে নিন শরিয়তের স্পষ্ট নির্দেশনা!

লিঙ্গে শক্তি না আসার ৫টি প্রধান কারণ

শা‘রী‘রিক স‘ম্প‘র্কের সময় কী করলে মেয়েরা বেশি তৃপ্তি পায়,